মগবাজার ওয়্যারলেস গেট রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে চা পান করছিলেন মাহমুদুল হাসান (৩১)। ট্রেনে ধাক্কা লেগে রেললাইনে পড়ে যান তিনি। ওই ট্রেনের নিচেই কাটা পড়ে মারা যান মাহমুদুল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অসাবধানবশত চা পান করার কারণেই মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে রেল দুর্ঘটনায় আরো কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।
জানা গেছে, রাজধানীতে গত এক মাসে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে অন্তত ২০ জন। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে রেলপথে ১০৫টি বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনায় ২৬ নারী ও ১১ শিশুসহ অন্তত ১১৩ জন নিহত এবং আরও ১৫ জন আহত হয়েছেন। গত আড়াই বছরে দেশে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আট শতাধিক। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরও ছয় শতাধিক। রেলওয়ে পুলিশের হিসাবমতে মৃতের সংখ্যা ৭০০। ২০১৯ সালে ৩৯৩টি রেল দুর্ঘটনায় ৮৯ নারী ও ৪৬ শিশুসহ ৪২১ জন নিহত এবং চার নারী ও ৩৩ শিশুসহ ৩৬৬ জন আহত হয়েছে। ১ জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত সারাদেশে বিভিন্ন রেলপথে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকার গণমাধ্যমকর্মীদের সংগঠন শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরামের (এসসিআরএফ) ‘রেলপথে দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৯’-এ এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা জানান, রেললাইনের ওপর অবৈধ বাজার, সিগন্যাল না মানার প্রবণতাসহ অসচেতনতাকে দায়ী করছে রেল পুলিশ। দুর্ঘটনায় হতাহতের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বেপরোয়া হয়ে কিছুসংখ্যক মানুষকে রেললাইনের ওপর দিয়ে দ্রুত হেঁটে ও দৌড়ে রাস্তা পার হতে দেখা যায়। তাদের কেউ মাছ বিক্রেতা, কেউ কলা বিক্রেতা আবার কেউবা সাধারণ পথচারী। শুধু পথচারীরাই নন, উঠতি বয়সী এক তরুণকে ব্যারিকেডের ফাঁকা জায়গা দিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেল চালিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রেললাইন ক্রস করতে দেখা যায়। কেউবা আবার মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছেন। মৃত্যু কমাতে রেললাইনে বেড়া দেওয়াসহ আধুনিক লেভেল ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা করার কথা জানিয়েছে রেলওয়ে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, নানা পদক্ষেপ নিলেও দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষের মৃত্যু থামছে না। রেললাইন ধরে অসতর্কভাবে হাঁটা, কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করা, তাড়াহুড়া করে রেলক্রসিং পার হওয়া এবং চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এছাড়া চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। শীতকালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ে। শীতকালে কান ঢাকা থাকায় ট্রেনের হর্ন শুনতে না পারা এবং কুয়াশার জন্য ট্রেনের লাইট দেখতে না পারায় দুর্ঘটনা বেশি ঘটে।
কানে হেডফোন লাগানো অবস্থায় তিন বছরে ৪৩০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পাঁচ বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু, লাশ উদ্ধার এবং লাশের ধরন সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে রেলওয়ে পুলিশ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, এক শ্রেণীর মানুষ ‘সেলফি’ তুলতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে তরুণ-তরুণীরা হাঁটতে গিয়েও অহরহ প্রাণ হারাচ্ছে। কানে হেডফোন লাগানো অবস্থায় তিন বছরে ৪৩০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পাঁচ বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু, লাশ উদ্ধার এবং লাশের ধরন সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে রেলওয়ে পুলিশ। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, এক শ্রেণীর মানুষ ‘সেলফি’ তুলতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। কানে হেডফোন লাগিয়ে তরুণ-তরুণীরা হাঁটতে গিয়েও অহরহ প্রাণ হারাচ্ছে।
জানা গেছে, দেশের ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর বেশির ভাগেই কোনো গেট নেই। কোনো সংকেতবাতি দূরের কথা, নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মী। নিয়ম অনুযায়ী কোনো রেললাইনের উপর দিয়ে সড়ক নিয়ে যেতে হলে গেট নির্মাণ, কর্মী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক সব স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই! সর্বশেষ মগবাজারে গত বৃহস্পতিবার ট্রেনের ধাক্কায় নিহত যুবকের বন্ধু ওসমান গনির বরাত দিয়ে ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) উপ-পরিদর্শক (এসআই) সেকেন্দার আলী জানান, নিহত মাহমুদুল হাসান ৭ দিন আগে সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন। তিনি রাজধানীর মিরপুরে বোনের বাসায় থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ উপজেলায়।
মালিবাগে দুই যুবকের মৃত্যু: রাজধানীর মালিবাগ গুলবাগ এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। ৬ জানুয়ারি দুপুরে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তারা হলেন- নেত্রকোনা কেন্দুয়া বাট্রা উপজলোর মুসলিম উদ্দিনের ছেলে নরু ইসলাম (২৭) ও একই জেলার মোস্তফার ছেলে রাকিব (২৫)। ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান জানান, মালিবাগ গুলবাগ এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় দুই যুবকের মৃত্যু হয়েছে। দুই লাইন দিয়ে দু’টি ট্রেন অতিক্রম করার সময় একটি ট্রেনে ধাক্কায় তাদের মৃত্যু হয়।
মগবাজারে শিক্ষার্থীর মৃত্যু : রাজধানীর মগবাজার এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মেজবাহ উদ্দিন (২৫) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিব উল হাসান বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, সন্ধ্যায় মগবাজার রেলক্রসিং পার হচ্ছিলেন মেজবাহ। এই সময় কমলাপুরগামী একটি ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে তার মৃত্যু হয়। স্বজনরা জানায়, মেজবাহ ঢাকা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে মাস্টার্সে পড়তেন। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার বালুরচড় গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ।
বনানীতে বৃদ্ধ দম্পতির মৃত্যু: ঢাকার বনানীতে ট্রেনে কাটা পড়ে বয়স্ক এক দম্পতির মৃত্যু হয়েছে, যারা সবুজবাগে ছেলের বাসায় থাকতেন। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে বনানী সৈনিক ক্লাব এলাকায় কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেসের নিচে তাদের মৃত্যু হয় বলে বিমানবন্দর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই মো. মহিউদ্দিন জানান। নিহতরা হলেন- অজিত চৌধুরী (৬০) ও তার স্ত্রী মনিষা চৌধুরী (৫০)। তাদের ছেলে অংকুর চৌধুরী রাতে মর্গে গিয়ে দুজনের লাশ শনাক্ত করেন। এএসআই মহিউদ্দিন বলেন, ওই দম্পতির গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার দক্ষিণ নালাপাড়ায়। ঢাকায় তারা সবুজবাগের মায়াকাননে ছেলের সঙ্গে থাকতেন। ছেলে অংকুর পুলিশকে বলেছেন, তার বাবা-মা বৃহস্পতিবার বিকালে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। আর প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশকে বলেছে, ওই দম্পতিকে তারা রেললাইনে বসে থাকতে দেখেছেন ট্রেন আসার আগে। কেন কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল, তা স্পষ্ট নয়। ছেলের আবেদনে ওই দম্পতির মৃতদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান এএসআই মহিউদ্দিন।
কুড়িল বিশ্বরোডে ৩ জনের মৃত্যু: রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় পৃথক সময়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন জন মারা গেছেন। নিহতদের একজন আল আমিন (১৬)। সে দিনমজুর হিসেবে কাজ করতো। বাকিদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। গত বছর ২৫ জুন দুপুরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। ঢাকা রেলওয়ে থানার বিমানবন্দর স্টেশনের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (এসআই) আমিনুল ইসলাম বলেন, ভোরের দিকে বিশ্বরোডের কাছে রেল লাইনে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেনে কাটা পড়ে আল আমিন নামের এক দিনমজুরের মৃত্যু হয়। তার বাড়ি কুড়িগ্রামে। এর আগের দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একই স্থানে আরেকটি ট্রেনের ধাক্কায় দুই জনের মৃত্যু হয়।
দিনাজপুরে বাইক চালক নিহত: চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি দিনাজপুরের পার্বতীপুরে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি সামনে রজনীগন্ধা রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মোটরসাইকেল চালক মো. কালাম (৩৯) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়। নিহত কামাল বিরামপুর উপজেলার লটকুমারী প্রয়াগপুর গ্রামের মৃত রমজান আলীর ছেলে। পার্বতীপুর জিআরপি থানার এসআই আবু সাঈদ জানান, বেলা ১১টায় কামাল একটি পুরাতন মোটরসাইকেল চালিয়ে রেল লাইন অতিক্রম করছিলেন। রেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় লাইনের উপর মোটরসাইকেলটি বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা পার্বতীপুরগামী আন্তঃনগর তিতুমীর এক্সপ্রেস তাকে ধাক্কা দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি।
নেত্রকোনায় দুইভাইসহ নিহত ৩: গত বছরের ১৮ অক্টোবর, নেত্রকোনা- মোহনগঞ্জ রেললাইনে ট্রেনের চাকায় কাটা পড়ে আপন দুইভাইসহ তিন জন নিহত হয়েছেন। ভোর ৬ টার সময় বারহাট্টা উপজেলার সাওতা ইউনিয়নের স্বল্প দশাল গ্রাম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হচ্ছেন, স্বল্প দশাল গ্রামের আব্দুল হেকিমের দুই পুত্র স্বপন মিয়া (২২) এবং রিপন মিয়া (২৪)। অপর জন হচ্ছেন একই গ্রামের কোরবান আলীর পুত্র মুখলেছ মিয়া(২৮)। এলাকাবাসী এবং মোহনগঞ্জ রেলওয়ে পুলিশ জানায়, স্বল্প দশাল গ্রামের রেললাইনের পাশের একটি ডোবা থেকে মাছ ধরার জন্য এই তিনজন রাতভর পানি অপসারণ করে। এতে তারা ক্লান্তি হয়ে ওইখানেই রেললাইনের উপর ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরের দিকে ঢাকা থেকে হাওর এক্সপ্রেস যখন মোহনগঞ্জ যাচ্ছিল তখন তারা ঘুমন্ত অবস্থাতেই এই ট্রেনে কাটা পরে এবং ঘটনাস্থলেই মারা যায়।
রায়পুরায় বৃদ্ধ নিহত: ৪ ডিসেম্বর নরসিংদীর রায়পুরায় এগারোসিন্ধুর ট্রেনে কাটা পড়ে মো. নজরুল ইসলাম (৬০) নামে এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। সকালে উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের হাঁটুভাঙা রেলক্রসিং পারাপারের সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত নজরুল শিবপুর উপজেলার খৈনকুড় এলাকার মৃত মোগল মিয়ার ছেলে। নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক শাহ আলম জানান, সকালে ওই বৃদ্ধ হাঁটুভাঙা রেলক্রসিং পাড় হচ্ছিলেন। এ সময় কিশোরগঞ্জগামী এগারোসিন্ধুর ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। তিনি আরো বলেন, নিহতের পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে লাশ দাফনের জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়াও গত বছর ১২ নবেম্বর রাত ৩টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা-নিশীথা ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন দু’টির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ১৬ জন ট্রেনযাত্রী নিহত হন। এর আগে গত ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে আরও চারজন নিহত হন।