প্রতিবছরের মতো এবারও রাজধানীর আশপাশের ইটভাটাগুলোতে শীত মৌসুমের প্রথম থেকেই ইট পোড়ানো শুরু হয়েছে। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর বাতাসে। রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ঢাকার আশপাশের ইটভাটা। অধিকাংশ ইটেরভাটা অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোর পরিবেশগত ছাড়পত্র যেমন নেই, তেমনি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিও গ্রহণ করেনি। এসব ইটভাটা মারাত্মক বায়ুদূষণের বড় উৎস। নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউর সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণায় ঢাকা শহরের বায়ুর গুণগত মানের এই চিত্র উঠে এসেছে। রাজধানী ঘিরে থাকা তুরাগ, বসিলা, মিরপুর ব্রিজ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, আশুলিয়া, আমিনবাজার, মিরপুর বেড়িবাঁধ, বালু নদীর আশপাশ, ফতুল্লা, শ্যামপুর, পাগলা ও বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোর বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ঢাকায় প্রবেশ করছে। কম উচ্চতার চিমনিতে ইট পোড়ানো হচ্ছে। বেশিরভাগ ইটাভাটাতেই অবৈধ ড্রাম চিমনি বসানো। ঢাকায় এখন উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ইট তৈরিতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিসাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের তাগিদ দিলেও আমলে নিচ্ছেন না ইটভাটার মালিকরা।
নিয়ম অনুযায়ী, সরকার ২০১৫ সালের পর পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নেই, এমন ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৩৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৩৭টি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। আর পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই ২ হাজার ৫১৩টির। এই দুটি শর্তই পালন করেনি এমন ইটভাটা রয়েছে তিন হাজারের বেশি।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এই বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুসে ঢুকে পড়ছে। যার কারণে মানুষ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এই বিষাক্ত বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় ফুসফুসে ঢুকে পড়ছে। এ কারণে মানুষ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণার ফলাফল জানিয়ে মানুষের স্বাস্থ্যে এর ক্ষতিকর দিক কী কী, তা জানতে চাইলে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল ফজল মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন বলেন, বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট হতে পারে। যাঁরা ইতিমধ্যে এই রোগে আক্রান্ত, তাঁদের এ রোগ বেড়ে যেতে পারে। ফুসফুসে বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া ধুলাবালু থেকে অ্যালার্জি, চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগ হতে পারে। হাঁপানি রোগ দেখা দিতে পারে।
গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গবেষণা অনুসারে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বস্তুকণা দ্বারা বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা ৫৮ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলা দ্বারা ১৮ শতাংশ, যানবাহনের জন্য ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্র পোড়ানোর জন্য ৮ শতাংশ ও অন্যান্য কারণে ৬ শতাংশ বায়ু দূষিত হচ্ছে। গবেষণার ফলাফলে পরিবেশ অধিদপ্তর ইট তৈরির অদক্ষ পদ্ধতি ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিসাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুপারিশ করেছে। রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলোর দূষণ শীত মৌসুমে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঢাকা জেলায় সাড়ে ৫০০ ইটভাটা রয়েছে, যার প্রায় অর্ধেকেরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। ইটভাটার দূষণে রাজধানীবাসী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট) প্রকল্পের গবেষণা দেখা যায়, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা প্রায় ৬২ শতাংশ দায়ী। এ ছাড়া সড়ক ও মাটি থেকে সৃষ্ট ধুলার মাধ্যমে ১৭ শতাংশ, যানবাহনের কারণে ৯ শতাংশ, বিভিন্ন জিনিসপত্র পোড়ানোর ফলে ৭ শতাংশ ও বিবিধ কারণে ৫ শতাংশ বায়ু দূষিত হচ্ছে।
বায়ুদূষণ নিয়ে ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা বেশি আছে এমন শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। শুধু ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য বছরে জিডিপির ১ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশও দিয়েছেন হাইকোর্ট।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, শীতের এই সময়টায় বৃষ্টি না হওয়ায় ঢাকায় বায়ুদূষণ পরিস্থিতি রীতিমতো আতঙ্কজনক পর্যায়ে রয়েছে। এখানে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে বিরাজ করছে। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ ১০০ পিপিএম পার হলেই বিপজ্জনক মাত্রায় বলে ধরা হয়। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’বিষয়ক পর্যবেক্ষণে গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকায় বাতাসে এর পরিমাণ ছিল ২৭০ পিপিএম ও নারায়ণগঞ্জে ৫৩২ পিপিএম। এটা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক। এর দু’দিন আগে ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় এর পরিমাণ ছিল ৩৮২ এবং নারায়ণগঞ্জে ৪৭৫ পিপিএম।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সূত্রে জানা গেছে, অনেক ইটভাটায় উচ্চ মাত্রার সালফার ব্যবহার করা হয়। সালফারের পরিমাণ যাচাই না করে এসব ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার করতে দেওয়ায় বায়ু দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক ভাটায় টায়ার ও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। এতেও অনেক কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। ইটের রঙ সুন্দর দেখাতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার হয়। এতে ইটভাটা এলাকার টিনের ঘরে মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে। ধান, অন্যান্য সবজি ও গাছের ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে ঠা াজনিত রোগ, শ্বাসনালির ক্ষতসহ নানা ধরেন মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে শিশু ও বয়স্কদের।
নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনআইএলইউর সহায়তায় পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় ঢাকা শহরের বায়ুর গুণগতমানের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। গবেষকরা ঢাকার বাতাসে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম ধূলিকণা ভেসে বেড়ায়। সহনীয় মাত্রার চেয়ে তা পাঁচগুণ বেশি। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের সবজি ব্যবসায়ী কবীর সরকার বলেন, শত শত ইটভাটার দূষণে তাদের এলাকার গাছপালা মারা যাচ্ছে। অনেকের ঘরের টিনে মরিচা পড়ে ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক খালেদ হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকা জেলায় ৫৪৪টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ২৬৬টি চলছে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি জিকজ্যাক ব্যবহার করছে ৩৮৪টি ইটভাটা। শিগগির অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, ইটভাটায় বছরে ২৫ লাখ টন কয়লা ও ২২ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। শীত মৌসুমে ঢাকার চারপাশে ইটভাটার দূষণে ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। এর প্রভাব ঢাকার বায়ুর ওপর পড়ছে।
ইটভাটা থেকে দূষণ হওয়ার কথা স্বীকার করেন বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির নেতা মো. আবু বক্কর। তিনি জানান, ঢাকার আশপাশে ১ হাজারের কিছু বেশি ইটভাটা রয়েছে। তিনি বলেন, ইটের ভাটাগুলোতে চিমনির সঙ্গে একধরনের পানির ঝরনা ব্যবহার করলে এই দূষণ অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সেটি ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে অনেকে এতে আগ্রহী হচ্ছেন না। দূষণের পাশাপাশি কৃষিজমিও নষ্ট হচ্ছে ইটভাটার কারণে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) পরিচালিত গবেষণায় বলা হচ্ছে, একটি ভাটা তৈরি করতে ২ লাখ ৩২ হাজার বর্গফুট জায়গা লাগে। এ ছাড়া ইটভাটার জায়গায় আর চাষাবাদ করা যায় না।
দূষণের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা কতটা দায়ী। সেখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে দূষণের মাত্রা কতটা ভয়াবহ। এটি রোধে আমাদের বিকল্প ইট তথা মাটি না পুড়িয়ে কীভাবে ইট তৈরি করা যায়, তা সম্পর্কে ভাবতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ইটভাটায় ব্যবহৃত মাটির বেশির ভাগই কৃষিজমির উপরিভাগ (টপ সয়েল) থেকে সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া ইট প্রস্তুত খাত দেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস। এ খাতে বছরে ২২ লাখ টন কয়লা ও ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়, যা বছরে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। যার প্রভাব ঢাকার বায়ুর ওপর পড়ছে