তিন দফা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পরে অবশেষে দাখিল হলো বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই’র আলোচিত দলিল লেখক রেজাউল করীম রিয়াজ হত্যা মামলার চার্জশিট।
তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে বাদী পক্ষের তুমুল বিরোধিতা ও নানা অভিযোগের মধ্যেই মামলার প্রধান আসামি নিহতের স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজা ও ইদ্রিস হাওলাদারকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েই এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সগির হোসেন কর্তৃক অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল করা এই তদন্ত প্রতিবেদনে অপ্রাপ্ত বয়স্ক দুই কিশোরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
অভিযুক্ত কিশোর অপরাধীদ্বয় হল- চরমোনাই’র রাজাধর এলাকার বাসিন্দা মোসারফ হোসেন চৌকিদারের ছেলে মো. নাঈম হোসেন বাবু ও একই এলাকার পিন্টু চৌকিদারের ছেলে মো. রায়হান। তাদের দু’জনেরই বয়স ১৭ বছর তিন মাস ১৮ দিন উল্লেখ করা হয়েছে।
স্ত্রী লিজা এবং নিহতের সহযোগী মাসুমের পরকীয়ার বলি নয়, বরং চার্জশিটভুক্ত মাদকাসক্ত দুই কিশোর চোর চুরি করতে গিয়েই এই হত্যাকা- সংঘটিত করেছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা মো. সগির হোসেন।
তবে দাখিলকৃত চার্জশিটের কোন স্থানেই উল্লেখ করা হয়নি হত্যা মামলায় শুরু থেকেই আলোচিত নিহত রিয়াজের সহযোগী মাসুমের নাম। ফলে এ চার্জশিটকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন মামলার বাদী নিহতের ভাই মো. মনিরুল ইসলাম রিপন। তিনি এ চার্জশিটে সন্তুষ্ট নন বিধায় এর বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দিবেন বলে জানিয়েছেন।
পাশাপাশি বরিশাল অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক মো. মাসুম বিল্লাহ চার্জশিট সম্পর্কে পর্যালোচনার জন্য আগামী ২২ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেছেন।
এ প্রসঙ্গে মামলার বাদী মো. মনিরুল ইসলাম রিপন অভিযোগ করেছেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা মো. সগির হোসেন মামলাটি নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস কালক্ষেপণ করেছেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রধান আসামি আমিনা আক্তার লিজাকে মামলা থেকে রক্ষা করা। এ বিষয়টি টের পেয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে গত ২৩ অক্টোবর অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার তদন্ত এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রতি আমরা না রাজি দেই। একই সাথে মামলাটি সিআইডিতে তদন্তের দাবি জানাই।
বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারক ১১ নভেম্বর মামলার সকল সিডি নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. সগির হোসেনকে স্ব-শরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। তবে করোনার অজুহাত দেখিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা ধার্য তারিখে আদালতে হাজির হননি। সবশেষ ৩০ নভেম্বর ধার্য তারিখ দুপুরে আসামি এবং বাদী পক্ষের আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে লিজা, মাসুম এবং ইদ্রিস হাওলাদারকে বাদ দিয়ে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন পুলিশ পরিদর্শক সগির হোসেন।
বাদী মনিরুল ইসলাম রিপন আরও জানান, ‘চার্জশিট দাখিলের সময় একমাত্র আমিই আদালতে উপস্থিত ছিলাম। এসময় চার্জশিটের বিষয়ে বিচারক আমার মতামত জানতে চাইলে আমি তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছি। বিচারক এই চার্জশিট নিয়ে কোন দ্বিমত থাকলে আদালতে না রাজি দিতে বলেছেন। আমরা চার্জশিট হাতে পেলে আদালতে না রাজির পাশাপাশি সিআইডি’র মাধ্যমে পুন:তদন্তের আবেদন জানাবো।
এদিকে, ‘তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে মনিরুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা সগির হোসেন তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পরে এক দিনের জন্যও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি। এমনকি লিজা’র পরকীয়া প্রেমিক মাসুম দফাদার এখনো আত্মগোপনে রয়েছে। তার মধ্যে কিভাবে তিনি এমন একটি কল্পকাহিনী সাজিয়ে চার্জশিট তৈরি করেছেন সেটা আমার বোধগম্য নয়। তবে আমি নিশ্চিত যে তিনি আসামিদের কাছ থেকে প্রভাবিত হয়েই এমন ভুয়া চার্জশিট দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সগির হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মামলার তদন্তকালে রিয়াজ হত্যার সাথে তার স্ত্রী লিজা’র জড়িত থাকার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া অভিযুক্তরা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার তদন্তে যেভাবে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে সেভাবেই চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। চার্জশিট বাদীর বিপক্ষে গেলে তিনি অভিযোগ তুলতেই পারেন।
উল্লেখ্য, ‘২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইছাগুড়া রাজধর এলাকায় নিজ বাড়িতে গলা গেটে হত্যা করা হয় দলিল লেখক রেজাউল করীম রিয়াজকে।
ওই ঘটনায় ১৯ এপ্রিল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক হওয়া নিহতের স্ত্রী আমিনা আক্তার লিজা স্বামীকে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি সম্পত্তির জন্য পরকীয়া প্রেমিক মাসুম এবং তার সহযোগীকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে স্বামী রিয়াজকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকার করেন।
এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন কোতয়ালী মডেল থানার উপ-পরিদর্শক বশির আহমেদ। পরবর্তীতে তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। এ কারণে তাকে বাদ দিয়ে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান একই থানার এসআই ফিরোজ আল মামুন। তদন্তে নেমে তিনি প্রথমে নিহতের মোবাইল সেট উদ্ধারসহ কয়েকজনকে আটকও করেন।
তবে এর মধ্যে হঠাৎ করে রহস্যজনক কারণে বাদীকে অবগত না করেই দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য চলতি বছরের গত ২৩ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাবেক ও বর্তমান কাউনিয়া থানার পরিদর্শক সগির হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়।