মাদারীপুরের শিবচরে থেমে থাকা বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডের (বালু টানা কার্গো) সঙ্গে ধাক্কা লেগে স্পিডবোট ডুবিতে অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় এখনো কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল সোমবার ভোরে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে এই দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস ও নৌপুলিশ নিখোঁজদের উদ্ধারে অভিযানে নামে। ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে, দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি এবং নিহেদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ট্রাফিক পরিদর্শক আশিকুর রহমান জানান, মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে সকাল পৌনে ৭টায় ৩০ জন যাত্রী নিয়ে স্পিডবোটটি ছেড়ে আসে। এ সময় মাদারীপুর কাঁঠালবাড়ী বাংলাবাজার পুরোনো ঘাটে থেমে থাকা বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডে ধাক্কা দিয়ে ডুবে যায় স্পিডবোটটি। এসময় সব যাত্রী পানিতে পড়ে যান। পরে নদী থেকে একে একে ২৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে আরও দুজনের মৃত্যু হয়। স্থানীয় ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এ উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেন।
নিহত ২৬ জনের মধ্যে ২১ জনের পরিচায় পাওয়া গেছে। তাদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলেন-খুলনার তেরখাদা উপজেলার বারুখালির মনির মিয়া (৩৮), হেনা বেগম (৩৬), সুমি আক্তার (৫) ও রুমি আক্তার (৩), ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার চরডাঙা গ্রামের আরজু শেখ (৫০) ও ইয়ামিন সরদার (২), মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার সাগর ব্যাপারী (৪০), কুমিল্লার দাউদকান্দির কাউসার আহম্মেদ (৪০) ও রুহুল আমিন (৩৫), মাদারীপুর জেলার রাজৈরের তাহের মীর (৪২), কুমিল্লা তিতাসের জিয়াউর রহমান (৩৫), মাদারীপুরের শিবচরের হালান মোল্লা (৩৮) ও শাহাদাত হোসেন মোল্লা (২৯), বরিশালের তেদুরিয়ার আনোয়ার চৌকিদার (৫০), মাদারীপুর রায়েরকান্দি মাওলানা আব্দুল আহাদ (৩০), চাঁদপুর জেলার উত্তর মতলব মো. দেলোয়ার হোসেন (৪৫), নড়াইলের লোহাগড়া রাজাপুর জুবায়ের মোল্লা (৩৫), মুন্সিগঞ্জ সদরের সাগর শেখ (৪১), বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের সায়দুল হোসেন (২৭) ও রিয়াজ হোসেন (৩৩), ঢাকা পীরেরবাগ খেরশেদ আলম (৪৫), ঝালকাঠি নালসিটির এসএম নাসির উদ্দীন (৪৫), বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জের মো. সাইফুল ইসলাম (৩৫), পিরোজপুরের চরখামার মো. বাপ্পি (২৮), পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার জনি অধিকারী (২৬)। এরমধ্যে ২১ জনের মরদেহ স্বজনদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে। আহত হয়েছেন চারজন। মাদারীপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে তাদের ভর্তি করা হয়েছে।
এ ঘটনা তদন্তে দুপুরে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন। কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলামকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবেন।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশাদুজ্জামান, শিবচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিরাজ হোসেন, শিমুলিয়া বি আইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন, মাদারীপুর শিবচর চরজানাজাত নৌ-পুলিশ ইনচার্জ শেখ মো. আব্দুর রাজ্জাক ও নারায়ণগঞ্জ পাগলা বাংলাদেশ কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার লে. আসমাদুল। এদিকে স্পিডবোট চালক শাহ আলমকে অসুস্থ অবস্থায় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, ইতোমধ্যে দুর্ঘটনা এলাকা পরিদর্শন করেছি। যারা দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। মর্মান্তিক নৌ-দুর্ঘটনায় যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলো শিশুটি : স্পিডবোট ডুবিতে পিতা-মাতা ও দুই বোনকে হারিয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল শিশু মিম। আজ সকালে দুর্ঘটনার পর নদীতে একটি ব্যাগ ধরে ভাসছিল মিম। এসময় নৌপুলিশ সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে। দুপুরে শিবচরের পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শিশু মিম শিবচর ইউএনও অফিসের এক কর্মচারি ও বাংলাবাজার স্পিডবোট ঘাটের নৈশ প্রহরী দেলোয়ার ফকিরের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের একটি কক্ষে দুপুরের ভাত খাচ্ছিল। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিশু মিমের বাবা মনির হোসেন, মা হেনা বেগম, ছোট দুই বোন সুমি (৫) ও রুমি (৩) স্পিডবোট দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
মিমকে উদ্ধারকারী নৌ পুলিশের কনস্টেবল মেহেদী বলেন, শিশুটিকে নদীতে ব্যাগ ধরে ভাসতে দেখি। হাত ও চোখের কাছে আঘাতের চিহ্ন ছিল সামান্য। দ্রুত তাকে পাঁচ্চর রয়েল হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিবারের সকল সদস্যরাই মারা গেছে। শিশু মিম শুধু জানে তার মা, বাবা, বোনেরা কেউ বেঁচে নেই। মাঝে মাঝেই মা মা বলে কেঁদে উঠছে সে। কান্নারত অবস্থায় মিম বলে, আমরা দাদু বাড়ি যাচ্ছিলাম। দাদা মারা গেছে। তাকে দেখতে। আমার আর কেউ নাই।
১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণের দাবি : স্পিডবোট দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি এবং নিহেদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবি জানান। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত লকডাউনের মধ্যেও এত বেশি সংখ্যক যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট চলাচলের জন্য ঘাট ইজারাদার, নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ড, বি আইডাব্লিউটিএ ও সমুদ্র পরিবহন অধিফতর কেউ দায় এড়াতে পারে না। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের এই ঘাটে মনিটরিংয়ের দায়িত্বরত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ এনে হত্যা মামলা করার দাবি জানান তিনি।
দেশের নৌ-পথ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে বলে মোজাম্মেল হক বলেন, সরকার নৌ-পথের উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও এ খাতে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসীনতা, দায়িত্বে অবহেলাসহ নানা কারণে নৌ-পথের যাত্রীদের নিরাপত্তা বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। তিনি বলেন, একদিকে লকডাউন ও অন্যদিকে কাল বৈশাখীর এহেন দুর্যোগপূর্ণ ভরা মৌসুমে ৮-১০ জন যাত্রী যাতায়াতের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি স্পিডবোটে লাইফ জ্যাকেটবিহীন ৩০-৩৫ জন যাত্রী নিয়ে যাতায়াত সারাদেশে নৌ-পথের অবহেলার চিত্র ফুটে উঠেছে। নৌ-পথে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব অবহেলায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ও আহতদের ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানান তিনি।