ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গোলাগুলীর ঘটনায় তাকে তলব করা হয়। এক মাসের মাথায় এ নিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে চারবার তলব করা হলো। গতকাল রোববার বেলা ১১টা ২০ মিনিটে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মো-কেসহ দুজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব উইংয়ের মহাপরিচালক মো. নাজমুল হুদা রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটের দিকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ত্যাগ করেন। এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের কোনাপাড়ার শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বাসিন্দা মো. ইকবালের লাশ গত শনিবার রাতে দাফন করা হয়েছে। রাতে পরিবারের সদ্যস্যরা শূন্যরেখার পাশে রোহিঙ্গাদের জন্য নির্ধারিত কবরস্থানে ইকবালের লাশ দাফন করে।
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হয় গুলী ও মর্টার শেল। এর আগে সবশেষ ৪ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মাইনুল কবির একই ঘটনায় রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মোকে তলব করে প্রতিবাদপত্র দেন। গত ২০ ও ২৮ আগস্টও মিয়ানমার থেকে মর্টারের গোলা বাংলাদেশ সীমানায় এসে পড়ে। সে কারণে ২১ ও ২৯ আগস্ট মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। রাখাইনে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘাতের ধারাবাহিকতাই এমন ঘটনা ঘটে চলেছে বলা হচ্ছে। তবে সব কিছু মাথায় রেখেই সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি রেখেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি মিয়ানমারের বিমান প্রবেশ, বাংলাদেশ সীমান্তের তুমব্রু এলাকায় মিয়ানমার ভূখ-ে থেকে ছোড়া একটি গুলী এসে পড়া, মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় পড়া এবং মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা একটি মর্টারশেল বাংলাদেশ সীমান্তে পড়ার ঘটনায় প্রায় মাসখানেকের কম সময়ের মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে চারবার ডেকে কড়া প্রতিবাদ করেছে ঢাকা। প্রতিবারই তার হাতে নোট ভার্বাল ধরিয়ে দেওয়া হয়। গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমারের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টারের একাধিক গোলা রাখাইনের ওয়ালিডং পাহাড়ের পাদদেশের শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে এসে পড়ে। এতে মো. ইকবাল নামের এক কিশোরের প্রাণ যায়। আহত হয় আশ্রয়শিবিরের পাঁচজন। চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের ভেতর থেকে ছোড়া এই মর্টারের গোলা এসে পড়েছিল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তমব্রু বাজার এলাকায়।
ওই দিন বেলা তিনটার দিকে তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখার ৩৫ নম্বর পিলারের কাছাকাছি জায়গায় গরু আনতে গেলে স্থলমাইন বিস্ফোরণে অথোয়াইং তঞ্চঙ্গ্যা (২২) নামের বাংলাদেশী এক তরুণের বাঁ পায়ের গোড়ালি উড়ে যায়। ঘুমধুমের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের হেডম্যানপাড়ার বাসিন্দা ওই তরুণের চিকিৎসা চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শূন্যরেখায় আরও মাইন পোঁতা থাকতে পারে, এমন শঙ্কায় মাঠে যাচ্ছেন না কৃষকেরা। গত শনিবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে রাখাইনের ওয়ালিডং পাহাড়ে গোলাগুলীর শব্দ শোনা যায়। এ অবস্থা চলে বেলা দুইটা পর্যন্ত। পরে গোলাগুলীর আওয়াজের তীব্রতা কমে আসে। স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিরা এ কথা জানিয়েছেন।
এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি গোলা তুমব্রু বাজারের পাশে কোনারপাড়ার কৃষক শাহজাহানের বাড়ির আঙিনায় এসে পড়ে। বাড়ির পাশেই শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। এর আগেও বাংলাদেশের ভূখ-ে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি গোলা এসে পড়েছিল। এসব ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল ঢাকা। তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় ৫ বছর ধরে আশ্রয়শিবির গড়ে তুলে বাস করছে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয়শিবির ঘেঁষে (পেছনে) মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও রাখাইন রাজ্যের একাধিক পাহাড়।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক এ পরিস্থিতির কারণে বান্দরবানসহ মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে বরাবরই এ ধরনের অস্থিরতার কূটনৈতিক সমাধানের কথা বলছে বাংলাদেশ। নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু চাকমা পাড়ার বাসিন্দা বাবু চাকমা গণমাধ্যমকে বলেন, কয়েকদিন আগে অসুস্থ মাকে দেখতে বান্দরবান সদর থেকে তুমব্রুতে বাড়িতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে আটকে গেলাম। ঘরে অসুস্থ মা, অন্যদিকে গোলাবারুদ ও থেমে থেমে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গুলীর শব্দে প্রতিনিয়ত আতঙ্কে সময় পার করছি। ঘুমধুম ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ার হোসেন জানান, মর্টারশেল ও স্থলমাইন বিস্ফোরণে হতাহতের পর স্থানীয়রা চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। ভয়ে সীমান্ত লাগোয়া জুম ক্ষেতে ফসল আনতে যাচ্ছে না অনেকেই। জুম ক্ষেতে নষ্ট হচ্ছে অনেকের ফসল।
এদিকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা তুমব্রুর বর্তমান অবস্থা নিয়ে সজাগ রয়েছে। জনগণের নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা প্রথমত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সজাগ করেছি। একই সঙ্গে জনগণকে নিরাপদে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঘুমধুমের এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র পরিবর্তন করে কুতুপালং নিয়ে গিয়েছি এবং পরীক্ষার্থীদের প্রশাসনের সহযোগিতায় গাড়িতে করে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাতায়াতের ব্যবস্থা করেছি। স্থানীয় জনসাধারণের বিষয়টি চিন্তা করেও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেব।
এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে কয়েকদিনের উত্তেজনা আর মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল নিক্ষেপে ইকবাল নামে ওই রোহিঙ্গা যুবকের মৃত্যু হয়। এতে কয়েকজন আহত হওয়ায় পর গতকাল রোববার সকালে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কার্যালয়ে। রুদ্ধদার এ সভায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, বিজিবি, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় তুমব্রু সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও পরামর্শ প্রস্তাব করা হয়েছে এবং তা দ্রুত সময়ে জেলা প্রশাসককে পাঠানোর মাধ্যমে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান ইউএনও সালমা ফেরদৌস।