নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী একটি লঞ্চডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত এক শিশুসহ ২৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার দুপুর একটায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটি নদীর পূর্বপাড়ে তুলে আনে। পরে তল্লাশী চালিয়ে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। গতকাল ২২ জনের এবং রোববার ৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এখনো নিখোঁজ তালিকায় আছেন ৬ জন। লঞ্চডুবির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই নদীর দুই তীরে স্বজন ও এলাকাবাসী ভিড় জমায়। শীতলক্ষ্যার তীরে বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন কেউ কেউ। নদীর দুইপাড়ে চলছে স্বজনদের আহাজারী। লাশগুলো শনাক্ত হওয়ার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর শুরু করেছে। বিআইডব্লিউটিএ উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করলেও র্যাব হেলিকপ্টারযোগে নিখোঁজদের সন্ধান করবে এবং ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ডুবুরী দল নদীতে সন্ধ্যা পর্যন্ত টহল করবে।
সোমবার সকাল থেকে ডুবে যাওয়া লঞ্চ উদ্ধার কাজ শুরু করে। বিআইডব্লিউটিএ, নৌবাহিনী, কোষ্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। লঞ্চটি উদ্ধারের পর দুপুর দেড়টায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করেন বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যন কমডোর গোলাম সাদেক। তিনি জানান, উদ্ধারকৃত লাশগুলো জেলা প্রশাসন স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করবে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, ৪৬ জন যাত্রীসহ লঞ্চ ডুবে গেলে অনেকে সাঁতার কেটে উঠতে পেরেছে। এ পর্যন্ত ২৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এরপরেও কেউ নিখোঁজ থাকতে পারে। তাই র্যাব এর একটি দল হেলিকপ্টার নিয়ে প্রহরা দিয়ে খোঁজ করবে। মৃতের পরিবারকে লাশ দাফন করার জন্য ২৫ হাজার টাকাসহ যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে।
এদিকে নিখোঁজ থাকার দাবির প্রেক্ষিতে ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ডুবুরী দল নদীতে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং প্রয়োজন হলে আরো বেশি সময় নিখোঁজদের সন্ধানে নদীতে টহলে থাকবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ছালেহ।
স্বজনদেও খোঁজে এখনো কয়েকজন নদীর পাড়ে আহাজারী করছেন। উদ্ধারকৃত লাশগুলোর মধ্যে তাদের স্বজনরা নেই বলে দাবি করেন। বিকেলে লাশ শনাক্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর শুরু করে। লাশ পাওয়া পরিবারের সদস্যরা শোকে আহাজারী করছেন। কোন কোন পরিবারের একাধিক সদস্য হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদা বারিক বলেন, ডুবে যাওয়া লঞ্চ নদীর তীরে এনে আজ তল্লাশী চালিয়ে প্রথম ২২ জনের এবং পরে আরও চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে লঞ্চডুবির ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৭ জনের লাশ উদ্ধার হলো।
এর আগের যে পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁরা হলেন মুন্সীগঞ্জ সদরের মালপাড়া এলাকার হারাধন সাহার স্ত্রী সুনিতা সাহা (৪০), উত্তর চরমসুরা এলাকার অলিউল্লাহর স্ত্রী সখিনা বেগম (৪৫), একই এলাকার প্রীতিময় শর্মার স্ত্রী প্রতিমা শর্মা (৫৩), সদরের নয়াগাঁও পূর্বপাড়া এলাকার মিথুন মিয়ার স্ত্রী সাউদা আক্তার লতা (১৮) ও অজ্ঞাত নারী (৩৪)।
মাটিতে গড়াগড়ি করে বুক চাপড়ে বিলাপ করছিলেন গৃহকর্মী ইয়াসমিন বেগম। সাত মাসের শিশুকন্যা মানসুরা ও স্বামী আনোয়ার শেখের সঙ্গে লঞ্চডুবির পর থেকে নিখোঁজ ইয়াসমিনের বোনের মেয়ে মাকসুদা বেগম (২৮)। তাদের খোঁজেই নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুর পাথরঘাট এলাকায় এসেছেন ইয়াসমিন।
ইয়াসমিনের সঙ্গে ছিল নিখোঁজ মাকসুদার দুই সন্তান মাহিন (১২), মাহিয়াসহ (৮) স্বজনেরা। পেশায় মৌসুমি ব্যবসায়ী স্বামীর সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে ঢাকার শনির আখড়ায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন মাকসুদা। গতকাল রোববার মুন্সীগঞ্জের আলদীপুরা বাজার এলাকায় বাবার বাড়িতে যাচ্ছিল তিনি।
শীতলক্ষ্যার তীরে বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন মাকসুদার স্বজনেরা। প্রতীক্ষায় আছেন জীবিত না হলেও অন্তত প্রিয়জনের লাশটুকু যেন পান। সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ইয়াসমিনদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। সকাল পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া পাঁচজনের লাশের মধ্যে তাঁদের স্বজনেরা নেই।
ইয়াসমিনের মতো অনেকে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে নদীর তীরে ভিড় করেছে। ঘটনার এত ঘণ্টা পর স্বজনদের জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা। তবে অন্তত প্রিয়জনের লাশটি পাবেন, সে আশায় আছেন। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বজনদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হচ্ছে। নদীর দুই তীরে এখন শুধু স্বজনের আহাজারি।