২০১৭ সালে সৌদি যান ৪০ বছর বয়সী আবিরন বেগম। ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ রিয়াদের আজিজিয়ায় তার মৃত্যু হয়। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর তার লাশ দেশে আসে। তার মতো আরও বহু নারীকর্মীর একই পরিণতি হয়েছে; কিন্তু বিচার হয়নি। নির্যাতনে প্রাণ গেলেও মৃত্যুসনদে লেখা ছিল স্বাভাবিক মৃত্যু বা আত্মহত্যা। সরকার বা দূতাবাস তৎপর না হওয়ায় দোষীদের শাস্তি তো দূরের কথা, মামলাও হয়নি।

আবিরনের লাশ দেশে আসার পর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তৎপর হয়। স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করে। কমিশনের সদস্য ড. নমিতা হালদারের তদন্তে বেরিয়ে আসে কীভাবে আবিরনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। কমিশনের আট দফা সুপারিশে আইনি লড়াই শুরু করে বাংলাদেশ দূতাবাস। গত ডিসেম্বরে মামলার শুনানি শুরু হয়।

সৌদির আদালত হত্যাকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে শরিয়াহ অনুযায়ী ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন। আবিরনের খুনিরা ক্ষতিপূরণ দিয়ে আপস করার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু তার পরিবার রাজি না হওয়ায় পার পাননি খুনিরা। টাকা নয়, কিসাস অর্থাৎ প্রাণের বদলে প্রাণ চেয়েছিল আবিরনের পরিবার। তবে সবাই আবিরনের মতো ‘সৌভাগ্যবতী’ নন। সৌদিতে বাংলাদেশি নারীকর্মীদের শ্রমবাজার যেমন বিশাল, মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ২১২ জন নারীকর্মী বিদেশে গেছেন। তাদের মধ্যে তিন লাখ আট হাজার ৮৮৩ জন সৌদি গেছেন। করোনাকালে ২০২০ সালে বিদেশ যাওয়া ২১ হাজার ৯৩৪ নারীকর্মীর মধ্যে ১২ হাজার ৭৩৫ জনের গন্তব্য ছিল রাজতান্ত্রিক দেশটি।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চার বছরে ৪১০ জন প্রবাসী নারীকর্মীর লাশ এসেছে। শুধু সৌদি থেকেই এসেছে ১৫৩ লাশ। ২০১৯ সালে আসে ৪৮ গৃহকর্মীর মরদেহ। যাদের ২০ জনের মৃত্যুর কারণ বলা হয় ‘আত্মহত্যা’। ২০২০ সালে ২২ গৃহকর্মীর লাশ আসে। ১৪ জনের মৃত্যুর কারণ দেখানো হয়েছে ‘আত্মহত্যা’। কিন্তু পরিবারের অভিযোগ, এগুলো নির্যাতনে হত্যা। ব্র্যাকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই বছরে ৬০ জন নারীকর্মী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। তারাও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার।

২০১৯ সালে সৌদি থেকে সোয়া তিন হাজার নারীকর্মী ফেরত আসেন। করোনার আগের ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে ফেরত আসেন ৬৫৪ জন। যাদের অধিকাংশ ছিলেন শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শিকার। তাদের আগেও হাজার হাজার নারী ফেরত এসেছেন নির্যাতিত হয়ে। এসবের একটি ঘটনারও বিচার হয়নি।

সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ সমকালকে বলেছেন, এসব ঘটনার বিচার না হওয়া দুঃখজনক; কিন্তু কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। চাইলেও সব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই কর্মী মামলার ঝামেলায় যেতে চান না।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেছেন, বহু ক্ষেত্রে লাশের গায়ে আঘাতের চিহ্ন থাকলেও মৃত্যুসনদে লেখা থাকে স্বাভাবিক মৃত্যু। তাদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ থাকলে পরিস্থিতি আজকের মতো খারাপ হতো না।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে দেশে আসে ১৪ বছর বয়সী কুলসুমের মরদেহ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই কিশোরীকে ২৭ বছর দেখিয়ে ভুয়া পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র করে বিদেশ পাঠিয়েছিল দালাল ও রিক্রুটিং এজেন্সি। গত বছরের মে মাসে সে বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিল, তাকে নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রী ও কর্তা। কুলসুমের পা, কোমর ও হাত ভাঙা ছিল। তার শরীর আঘাতে জর্জরিত থাকলেও মরদেহের সঙ্গে আসা সনদে লেখা ছিল ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি।

গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি মারা যান মুন্সীগঞ্জের মনিরা বেগম। তার লাশ আসে গত সেপ্টেম্বরে। মৃত্যুসনদে লেখা ছিল ‘আত্মহত্যা’। মনিরার মা মিনা বেগম আজও বিশ্বাস করেন না, তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। তিনি বলেছেন, তার মেয়েকে খুন করা হয়েছে। সাত মাস মেয়ের খবর পাননি। মেয়ে আগেই জানিয়েছিল কফিল (নিয়োগকর্তা) ভালো নয়। মারধর করে। এ ঘটনারও কোনো বিচার হয়নি।

নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেছেন, সৌদি আরবে ধর্ষণ, খুন, নির্যাতনের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু নির্যাতনের শিকার কর্মী দুর্বল ও অসহায় বলে মামলা করতে পারেন না। দূতাবাস ও সরকারেরও গাফিলতি রয়েছে। তারা আইনি সহায়তা দেয় না, তাই বিচারও হয় না। আবিরনের ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে, আইনি সহায়তা পেলে ন্যায়বিচার সম্ভব।

বিএমইটির মহাপরিচালক শামছুল আলম বলেন, অভিযোগ পেলে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। তবে এ বিষয়ে রিয়াদ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর মেহেদি হাসানের বক্তব্য জানা যায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন দাবি করেন, কেউ নির্যাতিত হলে যাতে ন্যায়বিচার পায়, সে জন্য সচেষ্ট রয়েছে দূতাবাস। দূতাবাসকে বলা হয়েছে, কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। কেউ অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকারের চেষ্টা হচ্ছে।

তবে দূতাবাস সূত্র জানিয়েছে, ২২ লাখ কর্মীর বিপরীতে শ্রম কাউন্সিলে কর্মকর্তা মাত্র পাঁচজন। এত সীমিত জনবল দিয়ে সব অভিযোগ শোনা যায় না। ব্যবস্থাও নেওয়া যায় না। কর্মীদের অভিযোগ, দূতাবাস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের অভিযোগের প্রতিকারে উদ্যোগী হয় না। উল্টো হয়রানি করে।

স্বামী পরিত্যক্তা আবিরন ছয় বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বোনদের পড়াশোনা ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য সৌদি আরব গিয়েছিলেন। আবিরনের বোন রেশমা আকতার বিমানবন্দরে তার লাশ গ্রহণ করে বলেছেন, তার বোনকে খাবার দেওয়া হতো না। যৌন নির্যাতন করা হতো। গ্রিলে মাথা ঠুঁকে মারধর করা হতো।

রায়ের খবরে রেশমা, তারা বৃদ্ধ বাবা আনছার আলী সরদার, মা মেহেরুন্নেসা খুশি। আবিরনকে হত্যার ঘটনায় দালাল রবিউলকে আসামি করে মানব পাচার আইনে দেশে মামলা হয়েছে। মামলাটি তদন্ত করছে খুলনার সিআইডি। এই মামলারও দ্রুত সুরাহা চায় পরিবার।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সমকালকে বলেন, এ রায় বাংলাদেশের জন্য সুখবর। প্রমাণ হলো, সৌদি আরবে সুবিচার রয়েছে। সৌদি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি নারী দেশটিতে কর্মরত আছেন। এ রায়ের ফলে তাদের কাজের পরিবেশ আরও সুরক্ষিত হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কর্মীদেরও সচেতন থাকতে হবে। কিছুদিন আগে এক নারীকর্মী অভিযোগ করেন, তিনি গৃহকর্তার দ্বারা ধর্ষিত হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। পরে ডিএনএ পরীক্ষায় জানা যায় গর্ভের সন্তান গৃহকর্তার নয়। তার বাংলাদেশি প্রেমিকের। প্রেমিককে বাঁচাতে ওই নারী মিথ্যা অভিযোগ করেন। মিথ্যা অভিযোগের কারণে প্রকৃত ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার পেতে সমস্যা হয়।

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রমকল্যাণ উইং আবিরন হত্যা মামলার বিচারকার্য ত্বরান্বিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। প্রবাসী অন্য কর্মীদের মতো বিচার নিশ্চিত করতেও কাজ করছে মন্ত্রণালয়।