ইবরাহীম খলিল: আজ ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, যার নাম বাংলাদেশ। মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচি দেয়া হয়েছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও।
এদিন ঢাকাসহ সারাদেশে প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
এ উপলক্ষে সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জাতীয় পতাকা এবং ঢাকা শহরে সহজে দৃশ্যমান ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে।
এদিন সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাণী প্রদান করেছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র, নিবন্ধ ও সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করবে। এ উপলক্ষে ইলেকট্রনিক মিডিয়াসমূহ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে।
এছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। কোস্টগার্ডের জাহাজসমূহ এ দিন দুপুর ২টা হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে।
ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতার আন্দোলনের মুখরতায় টালমাটাল ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখ ছিলো পবিত্র জুমাবার। সেদিন সুউচ্চ মিনার থেকে ভেসে আসা মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি, মুক্ত বিহঙ্গের উড়াউড়ি-ডাকাডাকি, নদীর নিঃশব্দে কিংবা কলকল রবে বয়ে চলা, এমনকি শাশ্বত সূর্যোদয়ের মধ্যেও নিহিত ছিলো অন্যরকম দ্যোতনা। কারণ সেদিন এ দেশের নির্বিশেষে মানুষ স্বাধীনতা লাভের অদম্য বাসনা নিয়ে পাকিস্তানীদের সীমাহীন ও অব্যাহত শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন। তাইতো দিনটি আবেগমথিত, মহিমান্বিত ও স্বাতন্ত্রে ভাস্বর। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক দিন আজ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী বাহিনী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হামলার মাধ্যমে বাঙালি জাতির জীবনে যে বিভীষিকাময় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, দীর্ঘ ৯ মাসে মরণপণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলার দামাল সন্তানেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সে যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। সাড়ে সাত কোটি মানুষ পেয়েছিলো নিজস্ব মানচিত্র, নিজের মতো করে একটি লাল-সবুজ পতাকা। অযুত জনতার আপোষহীন মনোভাব ও বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বতন্ত্র স্বাধীন জাতিসত্তায় বিশ্ববুকে অধিষ্ঠিত। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া নয়; গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মৌলিক অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। বিগত পাঁচ দশকেও এসবের কোনোটিই পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। আজ প্রত্যেকের উপলব্ধির সময় এসেছে ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’।
গোটা জাতি আজ সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করবে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বীর সেনানী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার। জাতি সেসব অজ্ঞাতনামা বীর শহীদদেরও স্মরণ করবে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেননি।
প্রস্তুত সাভার স্মৃতিসৌধ : ২৬ মার্চ উপলক্ষে ধোয়া মোছা ও প্রস্তুতির জন্য জনসাধাণের জন্য প্রবেশ বন্ধ রয়েছে স্মৃতিসৌধে। ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে সব প্রস্তুতির কাজ। দিবসটির সুচনা লগ্নে সাভার জাতীয় শহীদ স্মৃতিসৌধে শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদদের স্মরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, বিদেশী কূটনৈতিকবৃন্দ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ।
সুর্যোদয়ের সঙ্গে-সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন এসময় তাদেরকে সেখানে দেয়া হবে তিন বাহিনীর গার্ড অব অনার। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেয়া হবে।
২৬ মার্চ পালনে স্মৃতিসৌধের যাবতীয় প্রস্তুতির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। স্মৃতিসৌধের ধোয়া-মোছা ও রঙ-তুলির কাজও শেষ হয়েছে। বিভিন্ন ফুলের গাছ সাজানোসহ স্মৃতিসৌধ সাজানো হয়েছে নান্দনিক রুপে। দিবসটি পালনে সব প্রস্ততি সম্পন্ন করেছে সাভার গণপূর্ত বিভাগ।
সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্নের কথা উল্লেখ করে সাভার গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান গতকাল জানলেন, ২৬মার্চ উদযাপনে যাবতীয় প্রস্তুতি এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
২৬ মার্চ উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ এর আশেপাশে চারস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে স্মৃতিসৌধ ও এর আশেপাশের এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারী বাড়ানো এবং পুলিশ ওয়াচ টাওয়ার স্থাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। পোশাকে এবং সাদা পোশাকে আইনÑশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এদিন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকবেন বলেও জানান তিনি।