উজ্জ্বল কুমার সরকার
আজ ২৩ এপ্রিল বিশ্ববরেণ্য কিংবদন্তি বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের এক বিরল প্রতিভা, বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন সত্যজিৎ রায়। কিংবদন্তি এই চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক এবং লেখক সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ এপ্রিল তিনি মারা যান।
১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ২ মে কলকাতা শহরে সাহিত্য ও শিল্প সমাজের খ্যাতনামা রায় পরিবারে সত্যজিতের জন্ম। তার পূর্বপুরুষের বসতভিটা ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসুয়া গ্রামে। তার বাবা প্রসিদ্ধ শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায়। তার ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন সুপরিচিত লেখক, চিত্রকর ও দার্শনিক। সে সময় তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের একজন নেতা।
ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মায়ের সান্নিধ্যে বড় হন। বেড়ে উঠার অন্যতম অনুপ্রেরণাও ছিলেন মা সুপ্রভা দেবী। মা-ছেলের সম্পর্কের দিকটা সত্যজিৎ অনেকটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার ‘অপরাজিত’ সিনেমায়
সত্যজিৎ রায় শুধু চলচ্চিত্রকার নন, তিনি ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের সক্রিয় সারথি, বহুমুখী ব্যক্তিত্বের প্রতিভূ। কালান্তরের চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক, সঙ্গীত স্বর লিপিকার, সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পী।
তার শৈশব থেকে চলনে-বলনে, পোশাকে- আশাকে এমন এক সৌন্দর্য ছিল, যা মননশীল আভিজাত্যে পূর্ণ। মায়ের আদরের মানিকের চোখ দুটি গোল গোল, কান দুটি বড়, মাথায় এক ঝাঁকড়া চুল। যেন বাংলার শিল্প শহরে এক সাধকের আবির্ভাব। তার পুরো পরিবার ছিল সাহিত্য মনা।
শিল্প সাহিত্যের প্রতিটি কাজ মনোযোগ দিয়ে করে গেছেন তিনি। কোনো প্রতিষ্ঠান, বংশ নিয়ে অহমিকা ছিল না। চলনে ছিল না তাড়াহুড়া। জীবনের ইঁদুর-দৌড়ে অংশ নেননি। লোভে পড়ে মননশীলতা ভুলে যাননি। কাজ করতে গিয়ে বিপর্যস্ত করেননি কাউকে। ধীরে ধীরে সময় দিয়ে জীবনের হিসাব বুঝে নিয়েছেন।
অসংখ্য কাজের মধ্যে গ্রন্থ চিত্রণ ও প্রচ্ছদের কাজ করেছেন সত্যজিৎ রায়। তার শিল্প প্রতিভা দেখে প্রকাশক মনে করছিলেন, অলংকরণে তিনি বিশেষ সুনাম অর্জন করতে পারবেন। সিগনেট প্রকাশনের কর্ণধার ডি কে, কিংবদন্তি দিলীপ কুমার গুপ্তের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছিল। জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ ও ‘রূপসী বাংলা’র প্রচ্ছদ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ এবং জওহরলাল নেহেরুর ‘ডিসকভারি অব ইণ্ডিয়া’সহ বহু বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন তিনি।
দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ভিত্তোরিও ডি সিকা পরিচালিত ইতালিয়ান ছবি ‘দ্য বাই সাইকেল থিভস’ দেখে নির্মাণে অনুপ্রাণিত হন। সত্যজিৎ রায় খুঁজে পান কাজের নতুন দিগন্ত। মানুষের জীবন দেখার চোখ, সময় পাঠ ও প্রজ্ঞায় এগিয়ে যেতে থাকে তার শিল্প তরী। তৈরি করেন ‘পথের পাঁচালী’। যা বদলে দেয় ভারতীয় সিনেমার প্রেক্ষাপট। এর মধ্যে অনেক টানাপোড়নের গল্প আছে, আছে শিল্পের যন্ত্রণা। তবে তার কাজের অন্যতম অপুর ত্রিলজি, চারুলতা, মহানগর, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, হীরক রাজার দেশে, ঘরে-বাইরে, পরশ পাথর, নায়ক ইত্যাদি।
প্রজন্মের শেখার মতো অনেক ঘটনা আছে, অনেক অনুপ্রেরণার গল্প আছে। উদারতার ক্যানভাসে বলিউড শাহেনশা অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে শতরঞ্জ কি খিলাড়ি সিনেমায় কাজ করেন সত্যজিৎ রায়। এতে অমিতাভ বচ্চনকে ভাষ্যকার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। বিশ্বের কাছে তিনি পরিচালক বলে সমাদৃত। কারো কারো কাছে তিনি অত্যন্ত সমাদৃত লেখক।
শিল্পের নানা কাজে সাধারণ থেকে অসাধারণ, ব্যক্তি থেকে হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠান। যাকে ঘিরে কয়েক দশক ধরে জড়ো হয় শত জিজ্ঞাসা আর রহস্য। পরিণত হয়েছেন কিংবদন্তিতে, তৈরি হয়েছে কম জানা বেশি মানুষের উপাখ্যানে।
কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে চিরায়িত বাংলা ভাষা সাহিত্য পাঠকের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে তার সৃষ্ট তুখোড় চরিত্র- ফেলুদা, লালমোহন বাবু, প্রফেসর শঙ্কু, হীরক রাজা। ‘তাড়িনী খুড়ো’ যেন আজও জীবন্ত অনেকের কাছে। এছাড়া একের পিঠে দুই, আরও বারো, এমন মজার সব শিরোনামে ১২টির সংকলনে লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। সত্যজিৎ রায় সমগ্র’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চলচ্চিত্র বিষয়ক ‘একেই বলে শুটিং’, আত্মজীবনীমূলক ‘যখন ছোট ছিলাম’ এবং ছড়ার বই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’।
একবার বিবিসি বাংলার জন্য সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাতকার নেন কবি সৈয়দ শামসুল হক। প্রসঙ্গত কবি বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্যকে স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাংলা চলচ্চিত্রকে সত্যজিৎ রায়। বাংলা ও বাঙালির সুর ও অস্তিত্ব অনুভবকে তারা দুজনেই বিশ্বধারায় যোগ করে দিতে পেরেছিলেন। ফলে তাদের রচনা পরে বিশ্বসাহিত্য বা চলচ্চিত্রও আর আগের মতো থাকে না, হয়ে ওঠে অধিক ধনী।
রবীন্দ্রনাথের মতো সত্যজিৎও ছিলেন সব্যসাচী। সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের মতো সমবায়ী শিল্পের প্রধান প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের হাতে কাজ করেছেন। ফলে তার চলচ্চিত্র সর্ব অর্থে তারই করোটির সন্তান। আবার চলচ্চিত্র শুধু নয়, ব্যবহারিক শিল্পের ক্ষেত্রেও বঙ্গভূমে তিনি এনেছেন বিপ্লব বইয়ের প্রচ্ছদ, অলংকরণ, বাংলা হরফের রূপ নির্মাণ ও বিন্যাস রচনায়। ইংরেজি নতুন হরফ রূপ তিনি রচনা করেছেন রে-রোমান; লিখেছেন শিশু ও কিশোরদের জন্য কালজয়ী গল্প ও উপন্যাস এবং পরিমাণে খুব সামান্য হলেও বড়দের জন্যে অসাধারণ কিছু রচনা। আর চলচ্চিত্র সমালোচক ও তাত্ত্বিক হিসেবে তো তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠদের একজন।’ মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে সত্যজিৎ রায়কে ভারত রত্ন পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মৃত্যুর পর তাকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানিত করেন ডক্টরেট ডিগ্রী দিয়ে। চার্লি চ্যাপলিনের পর দ্বিতীয় ফিল্ম ব্যক্তিত্ব হিসেবে এই সম্মান পান সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ ছিলেন বহুমুখী এবং তার কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র,