বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি ও আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর। সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মৃত্যুর সংবাদে শোকের ছায়া নেমে আসে বিএনপির নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। শোক প্রকাশ করেছেন শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন সামাজিক  সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা। জানা গেছে, ব্যারিস্টার মওদুদের লাশ আজ না হলেও আগামীকাল বৃহস্পতিবার সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আনা হবে। লাশ দেশে আসার পরই তার দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপার্সনের ট্রেস উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান।
ব্যারিস্টার মওদুদের মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, খুব বেদনাহত সংবাদ- মওদুদ সাহেব আর নেই। আমি উনার ভায়েরার সাথে কথা বলেছি। তিনিই আমাকে সংবাদটি জানিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মওদুদ আহমদের এই চলে যাওয়া জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো। তিনি সারাদেশের একজন মুরুব্বী ছিলেন। অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান, আইনজ্ঞ ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন তিনি। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে, দেশের জনগণ একজন জনপ্রতিনিধিকে হারালো। মওদুদ আহমদের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তিনি।
মওদুদ আহমদের একান্ত সহকারী মোমিনুর রহমান সুজন বলেন, স্যার হাসপাতালে আইসিউতে ছিলেন। গত কয়েকদিন ধরেই তার অবস্থা সংকটাপন্ন ছিলো। টেলিফোনে জানানো হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় স্যার মৃত্যুবরণ করেছেন। গত ১৫দিন যাবত স্যারের ফুসফুসে পানি জমা হচ্ছিল। যার কারণে ফুসফুসে অক্সিজেন গ্রহণ ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। পাশাপাশি উনার কিডনি জটিলতাও দেখা দিয়েছে। আইসিইউতে নিয়ে উনার কিডনি ডায়োলেসিসও শুরু করার কথা ছিল।
গত ৩০ ডিসেম্বর রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমান হ্রাস, বুকে ব্যথা অনুভব করলে মওদুদ আহমদকে ঢাকায় এভার কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর গত ৭ জানুয়ারি তার হৃদযন্ত্রে  স্থায়ী পেস মেকার স্থাপন করা হয়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুদারের তত্ত্বাবধানে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, মওদুদ আহমদের একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল। শুধু বিএনপি নয়, পুরো দেশ উপমহাদেশের অন্যতম আইনজ্ঞকে হারালো। বিএনপি ও বাংলাদেশ হারালো একজন অভিভাবককে। তার এই মৃত্যুতে আমি ব্যক্তিগতভাবে শোকগ্রস্ত। কারণ তার সাথে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি আমাদের বিএনপির একজন অভিভাবক ছিলেন। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুও দলের জ্যেষ্ঠ এই নেতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। লন্ডনে অবস্থারত বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতও মওদুদ আহমেদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, তার এই মৃত্যুতে জাতি একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও আইনজ্ঞকে হারালো যা পূরণ হওয়ার নয়।
ব্যারিস্টার মওদুদের মৃত্যুতে আরো শোক প্রকাশ করেছেন গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।  তিনি বলেন, জাতি একজন বীর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও প্রবীন রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে। গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বীর প্রতীক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ব্যারিস্টার মওদুদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা  বঙ্গবীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন এবং রুহের শান্তি কামনা এবং পরিবারের সদস্যদের গভীর সহানুভূতি জানান। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি। শোক জানিয়েছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম এবং মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ। এক বিবৃতিতে ড. অলি বলেন, দেশ একজন প্রাজ্ঞ দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হারালো। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদর ছিল বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক এবং আইনানুগনে বিশাল সাফল্য। তার মৃত্যুতে  এলডিপির সর্বস্তরের নেতাকর্মী শোকাহত। তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা ও রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। শোক জানিয়েছেন লেবারপার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ও মহাসচিব ফারুক রহমান।
মওদুদ আহমদের স্ত্রী হাসনা জসীমউদ্দীন মওদুদ পল্লী কবি হিসেবে খ্যাত কবি জসীম উদ্দীনের মেয়ে।
দীর্ঘ ৮১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে বহু চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়েছেন মওদুদ আহমদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান পাশ করে লন্ডনের লিঙ্কন্স ইন থেকে ব্যারিস্টার-এ্যাট-ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডনে পড়াশুনা করে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করেন। তিনি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলনে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ব্যারিস্টার মওদুদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১-এ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আহূত গোলটেবিল বৈঠকে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছিলেন। মওদুদ আহমদ বাংলাদেশের প্রথম পোস্ট মাস্টার জেনারেল ছিলেন।
১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলে মওদুদ আহমদও দলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ১৯৭৭-৭৯ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।  সে সময় তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৫ এর নির্বাচনে মওদুদ আহমেদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সরকারের তথ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এক বছর পর ১৯৮৬ এ তাকে আবার উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৯ সালে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং এরশাদ তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করেন।
পরে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তিনি তার দল জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। এইচ এম এরশাদের সরকারের প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করা ব্যারিস্টার মওদুদ পরে আবার বিএনপিতে যোগ দিয়ে চারদলীয় সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে ১৯৯১ সালে মওদুদ আহমেদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালেও তিনি বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পাঁচবার মওদুদ আহমেদ নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলা থেকে নির্বাচিত হন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২৪ মে ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) নোয়াখালী জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও মা বেগম আম্বিয়া খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে মওদুদ আহমদ চতুর্থ।