নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড লিমিটেডের জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন নিহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হাসেমসহ আট শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আবুল হাসেমের চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম ও তানজীম ইব্রাহীমও রয়েছেন। অন্য তিনজন হলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহান শাহ আজাদ, হাসেম ফুড লিমিটেডের ডিজিএম মামুনুর রশিদ ও অ্যাডমিন প্রধান সালাউদ্দিন। গতকাল শনিবার দুপুরে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। আগুনে পাঁচতলার ফ্লোর ধ্বসে পড়েছে। ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বুয়েট থেকে বিশেষজ্ঞ এসে তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে বলেও ফায়ার সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছে। এদিকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন নিহতের ঘটনাকে ‘হত্যা’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান জানান, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় কারখানার মালিকসহ আটজনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা লোকজনকে আসামী করা হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, হত্যামামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সজীব গ্রুপের চ্যেপরম্যান মো. আবুল হাসেমসহ আট আসামীকে চার দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। গতকাল শনিবার বিকালে তাদের আদালতে তুলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে বিচারক চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান ইসমাইল জানান, শুনানি শেষে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুন তাদের চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। আদালত থেকে বের হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসেম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার কোনো বক্তব্য নেই। মামলা হয়েছে সেখানেই সব হবে’। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম জানান, আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ এনে ৩০২সহ কয়েকটি ধারায় এই মামলা হয়।
কারখানায় ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছিল না: সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানার ভবনটিতে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) দেবাশীষ বর্ধন। প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর গতকাল বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর তিনি সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রতিটি কারখানার ভবনের জন্য ফায়ার সেফটি প্ল্যানের একটি অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু ভবনটির নকশা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের অনুমোদন ছিল না। রাজউকের ছাড়পত্র, কারখানা অনুমোদনের ছাড়পত্র, পরিবেশের ছাড়পত্র নিয়েছিল কি-না, তা আমাদের জানা নেই। ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি শিফটে ৩০০-৪০০ ফায়ার ফাইটার কাজ করেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত তাপ সহ্য করেও ফায়ার ফাইটাররা প্রথম রাত থেকেই ভেতরে ঢুকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে। কারখানায় অনেক দাহ্য বস্তু ছিল। কিছুক্ষণ আগেও এক টন কাগজের রোল থেকে মাঝে মাঝে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। আমাদের টিম কাজ করে ধোঁয়া বন্ধ করে দেয়। তিনি আরও বলেন, শুক্রবার চারতলা থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আর হাসপাতালে তিনজনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। মোট ৫২ জন ছাড়া আর কোনো লাশ আমরা পায়নি। ভেতরেও আর কোনো লাশ নেই। এছাড়াও ঘটনার দিন ৫২ জনকে টিটিএল দিয়ে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ৪৫ ঘণ্টা সময় লাগার কারণ কী -এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারখানার আগুনটি ছিল হার্ড ফায়ার। এ ভবনে একাধিক সমস্যা রয়েছে। ভবনের প্রত্যেক ফ্লোরে নেট দিয়ে ব্যারিকেড ছিল। আবার কিছু কিছু জায়গায় তালাবদ্ধ ছিল। এরমধ্যেও আমরা কাজ করেছি। কারখানাটিতে একাধিক খাদ্য তৈরি হত। এগুলো প্যাকিং করার জন্য ফয়েল পেপার, প্লাস্টিকের বোতল, নিচতলায় ছিল টন টন প্যাকিং কাগজের রোল। এসব দাহ্য বস্তু থেকে আগুন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আমরা একদিকে পানি দিলে অন্যদিকে আগুন ছড়িয়ে যায়। বিভিন্ন দাহ্য বস্তু ও ক্যামিকেল থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশি সময় লাগে’ বলে জানান তিনি। অগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের এ উপ-পরিচালক বলেন, একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিসও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আগুনের সূত্রপাত, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, ভবনের দুর্বলতা ও কারখানায় আগুন নির্বাপণের যথেষ্ট সরঞ্জাম ছিল কি-না, সবকিছু তদন্তের পর বলা যাবে।
অগ্নিকাণ্ডে নিহতের ঘটনাকে ‘হত্যা’ বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জন নিহতের ঘটনাকে ‘হত্যা’ বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, এ ঘটনায় তদন্ত শেষে আইন অনুযায়ী বিচার হবে। গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘একটা দুর্ঘটনা হয়েছে, একটা হত্যা হয়েছে, অনেকগুলো মানুষ মারা গেছে, মামলা তো হবেই। মামলা হবে তদন্ত হবে, যারা দোষী, যারা সামান্যতম এর সঙ্গে দোষী বা (যাদের) দায়ী করা হবে তাদের বিচার হবে। গ্রেফতারদের প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মালিকসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। আমাদের পুলিশ বাহিনী মনে করে তাদের হয়তো সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। সে জন্যই তারা আটজনকে আটক করেছে। তিনি আরও বলেন, একসঙ্গে এতোজন লোকের প্রাণহানিতে সারাদেশে স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রথমে দেখলাম তিনজন, পরবর্তীতে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস কিছু জীবিত ব্যক্তিদের উদ্ধার করেছে। হাসেম ফুড ফ্যাক্টরির কতজন লোক এখানে কাজ করছিল সেটা তদন্তে বের হয়ে আসবে। ডিসি ও মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এসব কিছুর পরেই আমরা বলতে পারব এখানে কেন এ ঘটনা ঘটেছে। যাই ঘটুক তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক। যারা মারা গেছেন তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। যে কয়জন হাসপাতালে জীবিত আছেন আমরা মনে করি তারা সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। আত্মীয়-স্বজনকে যেন আল্লাহ শোক সহ্য করতে দেয় এ কামনা করি। তদন্ত শেষে আইন অনুযায়ী বিচার হবে মন্তব্য করে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, প্রথম কথা দেখুন আমাদের ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, ইউএনও, ডিসি তাৎক্ষণিকভাবে তারা এসেছেন।
লাশ শনাক্তে ৩৭ জনের নমুনা সংগ্রহ: আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৭ জনের লাশ শনাক্ত করতে ৩৭ স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ডিএনএ পরীক্ষক মো. মাসুদ রাব্বি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। লাশ শনাক্ত করতে সকাল থেকেই স্বজনেরা মর্গের সামনে ভিড় করেন। একমাত্র সন্তান মো. হাসনাইনের লাশ শনাক্ত করতে ভোলার চরফ্যাশনের অ্যাওয়াজপুর গ্রাম থেকে এসেছেন বাবা ফজলুল হক। তিনি জানান, আগুন লাগার পর থেকে তার ছেলে হাসনাইনের খোঁজ পাচ্ছেন না। হাসনাইনের মোবাইল ছিল না। তাদের এলাকার রাকিব নামের আরেক ছেলে হাসনাইনের সঙ্গে একই কারখানায় কাজ করতেন। রাকিবের ফোনে কল দিয়ে ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি। আগুন লাগার পর থেকে রাকিবও নিখোঁজ। বাবা ফজলুল হক আরও বলেন, যার মাধ্যমে এ কারখানায় হাসনাইন ও রাকিব কাজ করতে এসেছিলেন, সেই কন্ট্রাক্টর মোতালেব তাদের জানিয়েছেন, আগুন লাগার পর থেকে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জে খোঁজার পর তাঁদের পাওয়া যায়নি। এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে এসেছেন ছেলের খোঁজে।
দগ্ধ ৪৯টি লাশই পড়ে ছিল চারতলায়: ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেছেন, হাসেম ফুড কারখানা থেকে দগ্ধ ৪৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়। সব কটি লাশ পড়ে ছিল চারতলায়। চারতলা থেকে এসব লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেছেন তিনি। জিল্লুর রহমান বলেন, ভবনের কিছু কিছু ফ্লোর তালাবদ্ধ ছিল বলে জানতে পেরেছেন। তবে তদন্তের আগে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব হবে না। আগুনের সূত্রপাত বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, কোথা থেকে আগুন লেগেছে, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। তবে তদন্তের পর সেটি জানানো হবে। এত বেশি প্রাণহানির বিষয়ে তিনি বলেন, আগুনের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে যদি কারখানা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিত এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিত, তাহলে হয়তো মৃত্যুর সংখ্যা কম হতে পারত। এত বিশাল আয়তনের ওই ভবনে মাত্র দুটি সিঁড়ি ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক। তিনি বলেন, জাতীয় ভবন নীতিমালা অনুযায়ী, এই আয়তনের ভবনে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচটি সিঁড়ি থাকা জরুরি ছিল।
গত বৃহস্পতিবার বিকেলে রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস লিমিটেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই আগুনের ঘটনায় প্রথম দিন ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়। আহত হন অর্ধশত শ্রমিক। আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার পর শুক্রবার ওই ভবনের চারতলা থেকে ২৬ নারীসহ ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করে। সব মিলিয়ে ৫২টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে লাশ পুড়ে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। লাশগুলো উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদিকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান জানিয়েছেন, জায়গা না থাকায় ঢামেক মর্গ থেকে ১৫ জনের লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গে সংরক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে।