স্টাফ রিপোর্টার : আগামী বছর বদলে যাচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যমান কারিকুলামের আওতায় বছর জুড়েই অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। ২০২০ শিক্ষাবর্ষের ঘাটতি পূরণ করতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে নতুন বছরে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইতিমধ্যে শর্ত সাপেক্ষে পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১৬ জানুয়ারী পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে। আর সে কারণেই আগামী বছরের শিক্ষা কার্যক্রম কেমন হবে তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শিক্ষার্থীদের জন্য আগামী জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে বছর জুড়েই অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন করার। করোনার প্রভাব না থাকলেও চলবে অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবস্থা। একইসঙ্গে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীর ঘাটতি পূরণেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে শিক্ষাবর্ষে। এ জন্য এই নতুন বইসহ পুরাতন বছরের বই শিক্ষার্থীদের সংগ্রহে রাখতে বলা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া হবে। তবে এবার কোন উৎসব হবে না।
অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবস্থা ছাড়াও অনলাইনে পাঠদান, ভিডিও রেকর্ড করা পাঠদান চলবে। করোনা পরিস্থিতি না থাকলেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হবে সারা বছর। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম মো. ফারুক বলেন, ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট আমরা দীর্ঘদিন থেকে চালু করার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারিনি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টে নভেম্বর থেকে যেতে হলো। সেটা খুবই কার্যকর হয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এটিকে ভালোভাবে নিয়েছে। এতে প্রমাণ হয়েছে পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শেখা যায়। আগের বিদ্যমান পরীক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে কিছু শেখার নেই। কী শিখেছে তা যাচাই করা হতো। এই ব্যবস্থা শুধুই পরীক্ষানির্ভর। তাই করোনা না থাকলেও আমরা আগামী বছর ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্ট চালু রাখবো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। কেউ অন্যের মাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট কপি করলে বা অন্যের মাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করলে শিক্ষকরা তা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন। প্রয়োজনে নতুন করে একই অ্যাসাইনমেন্ট করাবেন। যেহেতু এখানে পরীক্ষার মতো কোনও নম্বর দেওয়ার বিষয় নেই, তাই শিক্ষার্থীকে শেখানোর জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে।
মহাপরিচালক আরও বলেন, শিক্ষার্থীর অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষকের কাছে যাবে, তখন শিক্ষক শিক্ষার্থীর দুর্বলতা খুঁজে পাবেন। ওই অ্যাসাইনমেন্টের দুর্বলতা নির্ণয় করে শিক্ষার্থীকে দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীরা তখন তাদের দুর্বলতা বুঝতে পারবে। শিক্ষকরা দুর্বলতা বুঝে শিক্ষার্থীকে শেখাতে পারবেন। প্রয়োজনে আবার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট পাঠের জন্য সক্ষম করে তুলবেন শিক্ষক।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, করোনার জন্য যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না যায় তাহলে আগামী তিন মাসের (জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করবো। এছাড়া অনলাইন ক্লাস তো চলবেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা গেলেও অনলাইন ক্লাস চলবে। এ বছরের ঘাটতির জন্য কিছু নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া আগামী বছর আমদের একটি প্যাকেজ যাবে। নতুন কারিকুলামের কিছু কনটেন্ট যাবে পুরাতন কারিকুলামে। প্রজেক্ট ওয়ার্ক থাকবে শিক্ষার্থীদের জন্য।
হল না খুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা : প্রায় ১০ মাস ধরে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বন্ধ রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বন্ধ রয়েছে পরীক্ষা। এতে করে সেশনজটের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছেন। এই অবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার আনুষ্ঠানিক অনুমতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ ৭ শর্ত দেয়া হয়েছে। তবে সরাসরি ক্লাস অনলাইনেই হবে। এর আগে ২ নভেম্বর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাসের অনুমতি দেয়া হয়।
করোনার সময়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা এবং ব্যবহারিক ক্লাস ও মূল্যায়ন বিষয়ে ৭টি শর্তেও মধ্যে রয়েছে, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সেমিস্টারের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়া যাবে। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত থাকতে হবে। মহামারি কোভিড-১৯ সংকটের কারণে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে বা হচ্ছে তা থেকে উত্তরণের জন্য এ সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসাসহ অন্যান্য শাখার অসমাপ্ত ব্যবহারিক ক্লাস এবং তার মূল্যায়ন স্বাস্থ্য বিধি মেনে পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করতে হবে। সেমিস্টার পরীক্ষা, ব্যবহারিক ক্লাস ও মূল্যায়ন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সর্বশেষ সেমিস্টারের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা অগ্রাধিকার পাবেন।
করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নির্দেশনায় বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো বন্ধ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাস পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্পন্ন করতে হবে। এজন্য শিক্ষার্থীদেরকে পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাস শুরুর ১ ঘণ্টা আগে ক্যাম্পাসে প্রবেশ এবং শেষ হওয়ার ১ ঘণ্টার মধ্যে ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হবে। কোভিড-১৯ সংকটের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে চলমান শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জারিকৃত নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালন ও অনুসরণ করতে হবে।
হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা, শিক্ষার্থীরা থাকবে কোথায়? করোনা পরিস্থিতির কারণে গত মার্চ থেকে বন্ধ আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গত জুন থেকে অনলাইনে ক্লাস চললেও কোনো পরীক্ষা হয়নি। হুট করেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২৬ ডিসেম্বর থেকে স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষাগুলো নেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষ আরো জানিয়েছে যে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ আবাসিক হলগুলো বন্ধই থাকছে।
কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের অনেকে আপত্তি জানিয়েছেন। বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা বলছেন, আবাসিক হল বন্ধ রেখে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক নয়। তাঁদের দাবি, পরীক্ষা নিতে হলে হলগুলো সীমিত পরিসরে হলেও খুলে দিতে হবে কিংবা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ভিসি মো. আখতারুজ্জামান বলছেন, এই মুহূর্তে পরীক্ষাগুলো নেওয়া খুব জরুরি। ফলে তাঁরা এর কোনো বিকল্প ভাবছেন না। তিনি বলেন, স্নাতক শেষ বর্ষ ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষাগুলো নেওয়া খুব জরুরি। করোনা পরিস্থিতির কারণে আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গার বিষয়টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলো সমন্বয় করবে। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে আর কোনো অপশন নেই।
হল খোলার বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেও ফেসবুক গ্রুপ ‘স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে’ গত সপ্তাহে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে ১৫ ঘণ্টায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থী বলেছেন, সীমিত পরিসরে হলেও (যাদের পরীক্ষা, শুধু তাদের জন্য) হল খুলে দিয়েই পরীক্ষা নেওয়া উচিত। হল খোলার বিরুদ্ধে বলেছেন ১৭০ জনের মতো। হল খোলার বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছে।