আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)। ছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন বিদেশে পলাতক। কী কৌশলে এত বিপুল পরিমাণ টাকা তিনি আত্মসাৎ করলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সেই তথ্য।
দুদক বলছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ করতে পিকে হালদার প্রথমে আত্মীয়স্বজন নিয়ে পারিবারিক সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তাদের কয়েকটি লিজিং কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক বানান। এর পর একক কর্তৃত্বে অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা নানা কৌশলে আত্মসাৎ করেন।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্র বলছে, টাকা আত্মসাৎ করতে গিয়ে পিকে হালদার অন্তত দুজন ব্যক্তির এনআইডি কার্ড দিয়ে ভুয়া কোম্পানি তৈরি করেন। এর পর ওইসব কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন করে তা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করেন। পরে তা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া ওইসব কোম্পানির নামে থাকা স্থাবর সম্পদও বিক্রি করে দেন তিনি। এমনকি আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি।
দুদক জানিয়েছে, পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে আরও ১০টি মামলা করা হবে। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান এসব মামলা করতে পারেন।
পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে গুলশান আনোয়ার প্রধানকে অনুসন্ধানকারী ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অনুসন্ধান পর্যায়ে অভিযুক্তদের ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত ১ হাজার ১০০ কোটি জব্দ করা হয়। এ ছাড়া জমি, হোটেল, বাড়ি সমমূল্য আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকাসহ মোট ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা জব্দ করে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, পিকে হালদার রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি থাকাকালে তার আত্মীয়স্বজনের আরও বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির স্বতন্ত্র পরিচালক পদে বসান এবং তার একক কর্তৃত্বে পিপলস লিজিংসহ বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির টাকা বিভিন্ন কৌশলে বের করে আত্মসাৎ করেন। এসব কোম্পানির স্থাবর সম্পদ বিক্রি করে দেন এবং আমানতকারীদের শেয়ার পোর্টফোলিও থেকে শেয়ার বিক্রি করে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, আদালতের কাছে পিকে হালদারের সহযোগী রাশেদুল হক স্বীকার করেছেন, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক ও রেজা গ্রুপের চেয়ারম্যান শহিদ রেজা ছিলেন পিকে হালদারের প্রধান সহযোগী। পিকে হালদারের নির্র্দেশে তার বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ২০০ কোটি ঋণ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া সিমটেক্সের মালিক সিদ্দিকুর রহমান, ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান উদ্দিন আহমেদ, পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান উজ্জ¦ল কুমার নন্দী, রাজীম সোম, কাজী মোমরেজ মাহমুদ, স্বপন কুমার বিশ^াস, অভিজিত, অমিতাভ অধিকারী, শংখ ব্যাপারী, সুস্মিতা সাহা, গোপাল চন্দ্র গাঙ্গুলী, অতশী মৃধা, অমল চন্দ্র দাস, রতন কুমার বিশ^াস ছিলেন পিকে হালদারের সহযোগী। পিকে হালদার মূলত এদের এনআইডি কার্ড দিয়ে ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে তা দিয়ে শত শত কোটি টাকা লিজিং কোম্পানি থেকে লুট করেছেন।
পিকে হালদারের খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী এবং পুরনো অফিসের সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দী। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উজ্জ্বল কুমার পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান এবং অমিতাভ পিপলস লিজিংয়ের পরিচালক ছিলেন। বেনামি প্রতিষ্ঠান দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে টাকা বের করে সেই টাকা দিয়ে পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন তারা। পরে একই কায়দায় পিপলস লিজিং থেকে টাকা বের করে প্রতিষ্ঠানটিকে পথে বসিয়েছেন।
মমতাজ বেগমের ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে কয়েক বছরে তার একাধিক হিসাবে জমা করা হয় ৪ কোটি টাকা এবং উত্তোলন করা হয় ২ কোটি ৫ লাখ টাকা। তার হিসাবে দুদক জব্দ করেছে ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
নওশেরুল ইসলামের ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস লিজিং ও পিপলস লিজিং থেকে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে তার একাধিক হিসাবে জমা হয় ৩৫২ কোটি টাকা এবং উত্তোলন করা হয় ২৪৩ কোটি ২০ লাখ কোটি। তার হিসাবে দুদক জব্দ করেছে ৯৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
বাসুদেব ব্যানার্জির ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে তার একাধিক হিসাবে জমা করেছেন ৭৬৪ কোটি টাকা এবং উত্তোলন করেছেন ৪৬২ কোটি। তার হিসাবে দুদক জব্দ করেছে ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
পাপিয়া ব্যানার্জীর ভুয়া কোম্পানির নামে একাধিক হিসাবে জমা হয় ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। উত্তোলন করা হয় ৪ কোটি। তার হিসাবে দুদক জব্দ করেছে ৬১ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, পিকে হালদারের বন্ধু মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক একেএম শহীদ রেজার স্বার্থসংশ্লিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে ১০৪ কোটি টাকা এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের সাতটি ঋণ হিসাব থেকে ৩৩টি চেকের মাধ্যমে ওয়ান ব্যাংকের স্টেশন রোড শাখার গ্রাহক ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফান আহমেদ খানের জেকে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে ৭৪ কোটি টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়। পিকে হালদারের ব্যক্তিগত হিসাবে ১৫৯ কোটি ৬৫ কোটি টাকা জমা ও উত্তোলন করা হয়; যা একজন ব্যাংকারের স্বাভাবিক লেনদেন নয়।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালনা পর্ষদ ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি ৬০ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। এমটিবি মেরিন লিমিটেডের নামে ঋণ প্রদান করা হলেও অর্থ সংশ্লিষ্ট হিসাবে জমা করা হয়নি। ঋণের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। আনান কেমিক্যালের এমডি অমিতাভ অধিকারী, বর্তমান চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও তার স্ত্রী পরিচালক অনিতা কর পিকে হালদারের সহযোগী ছিলেন। ব্যবসা সম্প্রসারণের নামে ৭০ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণ নিলেও একটি টাকাও ব্যবসার কাজে ব্যবহার না করে সব টাকা বিভিন্নজনের হিসাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে তুলে নেন। এটি ফান্ড ট্রান্সফার, যা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে গণ্য।
হাল ইন্টারন্যাশনালের এমডি সুস্মিতা সাহা, পরিচালক স্বপন কুমার মিস্ত্রি ও অভিতাভ অধিকারী হলেও প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করতেন পিকে হালদার। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে এ প্রতিষ্ঠানের নামে ৬০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পিকে হালদারের হিসাবে সরিয়ে নেওয়া হয়। এটিও মানি লন্ডারিং অপরাধ।
বেশিরভাগ ঋণের ক্ষেত্রেই মর্টগেজ ছিল না। অথচ ঋণ হিসাব থেকে সব টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। এ জন্য ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের বোর্ড অব ডিরেক্টরস ও চেয়ারম্যান এবং এমডি কোনোভাবেই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এসব ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে পিকে হালদারের সহযোগী ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল ইসলাম, সাবেক সিএফও আবেদ হোসেন এবং হেড অব বিজনেস রুনাই আহমেদ সরাসরি জড়িত।
সম্প্রতি দুদক সচিব মু আনোয়ারুল হাওলাদার বলেন, এখন পর্যন্ত পিকে হালদারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতায় ৬২ জনের নাম পেয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলা করে দুদক। মামলাটি তদন্ত করছেন দুদকের উপপরিচালক মো. সালাউদ্দিন। মামলার তদন্তকালে পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী অবন্তিকা বড়াল ও শংখ ব্যাপারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।